রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
পৃথিবীর চলমান গতিধারায় জন্ম নিয়েছেন হাজারো মনীষী। যারা জগদ্বাসীকে একটি সুন্দর ও মার্জিত সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সর্বোপরি যেসব মহাপুরুষ মুসলিম উম্মাহকে দেখিয়েছেন কল্যাণ ও সফলতার পথ, পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচয় করে দিয়েছেন নবী করিম (সা.)-এর আদর্শের সঙ্গে, এ যুগে তাদেরই একজন হজরত মাওলানা আকরাম আলী। লিখেছেন বেলায়েত হুসাইন
হজরত মাওলানা আকরাম আলী ফরিদপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়ার (বাহিরদিয়া মাদ্রাসা) মুহতামিম। অত্যন্ত প্রতিভাবান, তীক্ষন জ্ঞানের অধিকারী এ মহান মনীষী শুধু নিজের জীবনকেই আলোকিত করেননি; বরং জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও আলোর পথের সন্ধান দিয়ে যাচ্ছেন গোটা উম্মাহকে।
জীবন্ত কিংবদন্তি এই আলেম ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার অন্তর্গত রামকান্তপুর ইউনিয়নের বড় বাহিরদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম খন্দকার আবদুল মালেক। দাদা, খন্দকার ছদরউদ্দিন (রহ.)। তারা ১২ ভাইবোন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। তার বড় ভাই জেলার আরেক বুজুুর্গ আলেম ও বাহিরদিয়া মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা আশরাফ আলী (রহ.)।
মাওলানা আকরাম আলীর চাচা মাওলানা আবদুল আযীয (রহ.) ছিলেন সমকালীন যুগের প্রখ্যাত আলেম। তার প্রাথমিক শিক্ষার শুরু চাচার কাছে। পরে চাচার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় অতি সহজেই তিনি উস্তাদদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। নিরলস প্রচেষ্টা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম করে তিনি একাগ্রচিত্তে ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। এখানে তিনি শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করেন।
বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়ার পর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি রাজধানীর জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগে আসেন। ইলমে দ্বীন অর্জনের প্রবল আকাক্সক্ষা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। কিতাবের সংস্পর্শ ছাড়া কিছুতেই আত্মপ্রশান্তি অনুভূত হতো না তার। এখানে এক বছর জ্ঞান-সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে ইলমের প্রতি পিপাসা আরও তীব্র হয়। দাওরায়ে হাদিস পড়ার জন্য চলে যান চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়। এখান থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। হাটহাজারীতে তখন তিনি তৎকালীন বড় বড় আলেমের শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হন।
মাওলানা আকরাম আলীর কর্মজীবন অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সমাপ্ত করেই দ্বীনি ইলমের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। সর্বপ্রথম যশোরের মনিরামপুরের মাছনা মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের শুরু। এ মাদ্রাসায় তিন বছর নাজেমে তালিমাতের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭০ সালে বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় আসেন এবং দীর্ঘ ১৬ বছর এখানে তালিমাতের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চলে যান ফরিদপুর শহরের খাবসপুরের জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলুমে। তিনি যাওয়ার পর খাবাসপুর মাদ্রাসায় কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস চালু করা হয়। এখানে এক বছর তালিমাতের দায়িত্ব পালন করেন।
খাবাসপুর মাদ্রাসা থেকে এসে ১৯৮৮ সালে মুহতামিম হিসেবে আবার যোগ দেন জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়ায় এবং আজ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে এখানের মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বিগত প্রায় তিন যুগ, তার দায়িত্বকালে মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিবেশের বেশ উন্নতি হয়েছে। মাদ্রাসার ভৌগোলিক পরিধি বিস্তৃতকরণ, সুরম্য পাকা ভবন নির্মাণ, আধুনিক ও অভিজাত মসজিদ এবং অজুখানা নির্মাণে মূল অবদান মাওলানা আকরাম আলীর।
অর্ধশতাব্দী ধরে শিক্ষাদানের সময় তিনি অসংখ্য কৃতী ছাত্রকে পড়িয়েছেন। যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সুনামের সঙ্গে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারসহ বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজ সম্পাদন কর যাচ্ছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় হওয়া ইসলামভিত্তিক আন্দোলনে মাওলানা আকরাম আলীর সরব ভূমিকা রয়েছে। তার এই ভূমিকাই তাকে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের গ্রহণযোগ্য আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে। এ অঞ্চলে যখনই ইসলামবিরোধী কোনো কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিবাদে সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশ ও উম্মাহর সংকটে স্থানীয় আলেম ও এলাকাবাসীকে সঙ্গে করে তা উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। এজন্য রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে তার ব্যাপক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা তার প্রতি আস্থা রাখেন।
মাওলানা আকরাম আলী যে সময় ইলমে দ্বীনের খেদমতে আসেন, তখন এ এলাকা শিরক-বিদআদসহ নানা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আইয়ামে জাহিলিয়াতের মতো এখানের অনেক মানুষ মাজারপূজা, পীরপূজা, মিলাদ-কিয়ামের মতো ভিত্তিহীন বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ পালনের রীতি ছিল। অথচ তাদের মধ্যে বাস্তবিক ইসলাম পরিপালন ও ইসলামি রীতিনীতি অনুসরণের বালাই ছিল না। ফরিদপুরের নানা জায়গায় ইমানবিধ্বংসী নানা ধরনের কুসংস্কার পালিত হতো। মাদ্রাসায় ইলমে দ্বীন শিক্ষার পাশাপাশি মাওলানা আকরাম আলী এসব অপসংস্কৃতি ও বাতিল কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে দমন করেছেন। হকের প্রচারে তিনি কঠিনভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েও নিজ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ২০০০ সালে তিনি একবার কারাবরণও করেন।
মাওলানা আকরাম আলী মানুষের সামনে হক প্রচারে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। এখনো তিনি সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার প্রতিরোধে সমানভাবে সচেতন।
আধ্যাত্মিকতাচর্চায়ও মাওলানা আকরাম আলী দেশ-বিদেশের বুজুর্গ আলেমদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-সহ সে সময়কার বড় বড় আলেমের সঙ্গে তার গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। হাফেজ্জি হুজুুর (রহ.)-এর জামাতা আল্লামা আবদুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.) তাকে খেলাফত দিয়েছেন। একই সঙ্গে শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী (রহ.)-ও বাহিরদিয়া মাদ্রাসার এক মাহফিলে তাকে খেলাফত ও এজাজত দেন। আধ্যাত্মিকতার চর্চার ময়দানে তিনিও এ পর্যন্ত কয়েকজন শাগরিদকে খেলাফত ও এজাজত দিয়েছেন। লেখালেখির খেদমতে তিনি খুব সরব না হলেও এরই মধ্যে কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। তবে এখনো সেগুলো প্রকাশের অপেক্ষায়।
শিক্ষাজীবন শেষ করার কয়েক বছর পর ১৯৭২ সালে মাওলানা আকরাম আলী রাজবাড়ীর সোনাকান্দার পীর সাহেবের বাড়ির এক কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার আট সন্তান, বড় ছেলে মাওলানা ইমরান আলী বাহিরদিয়া মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করছেন, ছোট ছেলে মাওলানা এহসান আলী বাহিরদিয়া মহিলা মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। ছয় মেয়ের সবারই বিয়ে হয়েছে বড় বড় আলেমের সঙ্গে। তার বড় জামাতা মাওলানা আমীর হুসাইন ঢাকার পীরেরবাগে মাদ্রাসা শামসুল উলুম নামে নিজস্ব মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরেক জামাতা মাওলানা অলিউর রহমান বর্তমানে বাহিরদিয়া মাদ্রাসার নাজেমে তালিমাত এবং ছোট জামাতা মাওলানা মুফতি মাহদী হাসান বাহিরদিয়া মাদ্রাসার ইফতা বিভাগের দায়িত্বশীল। আরেক জামাতা মাওলানা সালেহ নুমানী রাজধানীর দারুস সালাম মাদ্রাসার মুহাদ্দিস। মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন নামে অন্য জামাতা জামেউল উলুম ঢাকায় হাদিসের অধ্যাপনা করেন। দারুস সালাম টেকনিক্যাল মসজিদের ইমাম-খতিব ও মিরপুর একটি মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুফতি আবদুল্লাহ আল হাদীও মাওলানা আকরাম আলীর জামাতা।
জন্ম সাল হিসেবে হুজুরের বর্তমান বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। জীবনের এ পড়ন্ত বেলায়ও সেই যৌবনের মতো সমানভাবে ইলমের খেদমত করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ সময় তিনি মাদ্রাসায় কাটান এবং দরস-তাদরিসে মশগুল থাকেন। সাধারণ মানুষের ইসলাহ ও আত্মসংশোধনের নিমিত্তে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিল ও সভা-সেমিনারে অংশ নেন। বাহিরদিয়া মাদ্রাসায়ও প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে ইসলাহি মাহফিলে মুরিদদের আধ্যাত্মিকতার পাঠ দেন। দ্বীনের এ রকম আরও অসংখ্য খেদমত করে চলেছেন মাওলানা আকরাম আলী। মহান আল্লাহ আমাদের ওপর তার ছায়াকে আরও দীর্ঘায়িত করেন এবং দেশ, জাতি ও উম্মাহর বহুমুখী খেদমতে তাকে আরও বহুদিন নিয়োজিত রাখেনÑ আমরা তার জন্য এই দোয়া করি। আল্লাহ কবুল করুন। আমিন।
ভয়েস/আআ